আপনি যদি কাউকে প্রশ্ন করেন, সোনা কোথায় পাওয়া যায়? সে হয়তো এক বাক্যে উত্তর দেবে ‘সোনা খনি থেকে উত্তোলন করা হয়’। অনেকেই হয়তো ডিসকভারি বাংলা চ্যানেলের প্রোগ্রাম ‘গোল্ড রাশ আলাস্কা’ দেখে বলে দেবেন যে কাদামাটির স্রোত থেকে সোনা পৃথক করা হয়। কিন্তু ঘটনা আসলেই কি তাই? আপনার কাঙ্খিত যে ধাতুটি এত এত মূল্যবান, তার উৎপত্তি কি এতটাই সহজ? চলুন জেনে নেয়া যাক।
বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, আমাদের মাথার উপরের সৌরজগৎ তৈরির বহু আগে এক সুপারনোভা ও নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর যাবতীয় সোনার উদ্ভব হয়েছিল যা বিজ্ঞানীদের কাছে আর-প্রোসেস নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, পৃথিবী এমনকি সৌরজগৎ সৃষ্টির আগে সোনা তৈরি হয়ে থাকলে তা পৃথিবীতে এলো কীভাবে? উত্তরটা সহজ, পৃথিবীর অন্যতম গঠন উপাদান হলো এই সোনা। পৃথিবীর কেন্দ্র, যাকে ‘কোর’ বলা হয়ে থাকে, সেটি গঠিত হওয়ার সময় সময়ই তার অন্যতম গঠন উপাদান হিসেবে সোনা অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কে না জানে এই কঠিন পৃথিবী এসেছে গলিত অবস্থা থেকে। পৃথিবী সৃষ্টির সময় এর কেন্দ্রে লোহা ও সোনার মতো ভারী ধাতুগুলো আশ্রয় নেয়। তাই একটা কথা বলতেই হয়, পৃথিবীর সকল সোনার উৎপত্তি হয়েছে মৃত নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে।
বিভিন্ন সময় বিশেষ করে পৃথিবীর বয়স যখন কম, তখন এর সাথে বিভিন্ন গ্রহাণুর সংঘর্ষ হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সাথে নিয়মিত বিভিন্ন গ্রহাণুর সংঘর্ষ হতো। এসব সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর অনেক গভীর পর্যন্ত কেঁপে উঠত এবং বেশ কিছু সোনা পৃথিবীর উপরিভাগের স্তরগুলোতে এসে আশ্রয় নিত। এভাবে ভূ-অভ্যন্তর থেকে অনেক সোনা আমাদের হাতের নাগালের দূরত্বে এসে পৌঁছেছে, যা আমরা এখন খনিতে গর্ত খুলে উত্তোলন করে থাকি। এছাড়া ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমেও পৃথিবীর উপরিভাগের স্তরগুলোতে সোনা এসে থাকতে পারে!
সোনা উত্তলনের প্রক্রিয়া
সোনা উত্তোলন করতে প্রথমে জরিপ করে নিদিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এরপর ড্রিল করে সোনার সঠিক অবস্থান জানা হয় এবং নির্দিষ্ট ব্যাবধান অন্তর অন্তর ড্রিল করে খনির ভেতর কত সোনা থাকতে পারে তার একটা খসড়া হিসেব বের করে নেওয়া হয়। তারপর খনি থেকে সোনা তুলে প্রোসেস করে খরচ বাদ দিলে লাভ কতটা থাকবে তা দেখে নেওয়া হয়। কারন এটা অনেক ব্যয়বহুল এক প্রক্রিয়া।
সমস্ত জরিপ শেষে গভীর গর্ত খনন করা হয়। এরপর গর্তে নিয়ন্ত্রিত মাইন বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়। কারণ সোনা খনির ভূমি গুলো মূলত আকরিকে পূর্ণ। তাই অন্য যে কোনো জায়গার থেকে তুলনামূলক অনেক শক্ত পাথরি ভূমিতে হাতুড় খুন্তি দিয়ে সোনা খোজা অনেক সময়, ব্যয় ও কষ্ট সাপেক্ষ। তাই মাইনিং করে পাথরের পাহাড় এর একবারে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ টুকরো টুকরো করা হয়। এর পর এই সোনাযুক্ত আকরিকের টুকরো গুলোকে ট্রাকে বোঝাই করা হয় এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ সেন্টারে পাঠানো হয়।
এখানে আকরিকগুলিকে আরও ছোট ছোট খন্ডে ভাঙা হয়। তারপরে, শক্ত পাথর থেকে সোনাকে আলাদা করতে সোডিয়াম সায়নাইড ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় লিচিং। লিচিং এর মাধ্যমে আরোহিত সোনা আকরিকের কাদামিশ্রিত অবস্থায় থাকে। সোনা মিশ্রিত কাদা একটি পরিশোধক চুল্লীতে পাঠানো হয় এবং তাতে সোনা এবং রূপার গলনাঙ্ক অনুযায়ী উত্তপ্ত করে সোনা এবং রূপা আলাদা করা হয়। তবুও এটি পুরোপুরি পরিশোধিত হয়না। এর ফলে একটি 98% সোনা-রূপার মিশ্রণ তৈরি হয় যাকে বলা হয় ডোর (Dore). এরপর 99.99% খাঁটি বা 24 ক্যারেট সোনা পেতে, আকরিকটি আবার একটি বিশেষ শোধনাগারে পাঠানো হয়।