১২ ডিসেম্বর ২০২১ এ ঢাকার ও ঢাকার অদূরের ২০০ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভাবে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় এলো। প্রযুক্তিটি নতুন হওয়ায় আমরা আসলে তেমন করে জানিইনা ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক আসলে কি?
🔰 মূলত ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক হলো মুঠোফোনের পঞ্চম জেনারেশন ইন্টারনেট সংস্করণ। বর্তমানে চলমান ফোর-জি এলটিই (লং টার্ম ইভল্যুশন) নেটওয়ার্কের আপগ্রেড ভার্সনকে ফাইভ-জি বলে।
তাই ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে আগে ফোর-জি এলটিই সম্পর্কে
ভালো ধারণা থাকা চাই।
🔰 ফোর-জি এলটিই
ফোরজি হলো ফোর্থ জেনারেশন বা চতুর্থ প্রজন্ম শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি ব্যবহৃত হয় চতুর্থ প্রজন্মের তারবিহীন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিকে বুঝাতে। এটি তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উত্তরসূরি। ফোরজি প্রযুক্তি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মোবাইল যন্ত্রে মোবাইল ব্রডব্যান্ড মোবাইল আল্ট্রা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে।
এলটিই (LTE – Long Term Evolution) বলতে মুঠোফোন এবং ডাটা টার্মিনালগুলোর উচ্চগতির তথ্য আদান-প্রদানে বেতার যোগাযোগকে বোঝায়। এর পুরো নাম থ্রিজিপিপি লং টার্ম ইভ্যুলুশন (3GPP Long Term Evolution)। এ প্রযুক্তিতে ল্যাটেন্সি কম হওয়ায় বাড়ে নেটওয়ার্ক রেসপন্স। ল্যাটেন্সি বলতে কোনো সাইট অ্যাকসেস করা এবং তার রেসপন্স করার মধ্যবর্তী সময়কে বোঝায়।
🔰 গতির এই হিসাব প্রথম শুরু হয় ওয়ান–জি দিয়ে ১৯৭৯ সালে এনালগ পদ্ধতির মাধ্যমে, যেখানে দুটি ডিভাইসের মধ্যে শুধু কল করা যেত।
🔰 এরপর ১৯৯১ সালে আসে টু–জি (দ্বিতীয় জেনারেশন)। এখানে দুটি মুঠোফোন ডিভাইসের মধ্যে কল করার পাশাপাশি টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো সম্ভব হতো।
🔰 তারপর ১৯৯৮ সালে আসে থ্রি–জি (তৃতীয় জেনারেশন), যা টেক্সট ম্যাসেজ, কল, ইন্টারনেট ইত্যাদির সঙ্গে ব্রাউজ করার সুবিধা ছিল।
🔰 এরপর থ্রি–জির সব সুবিধাসহ ফোর–জি আসে ২০১০ সালে। এতে সহজেই একসঙ্গে অনেকগুলো ডিভাইস কানেক্ট করা এবং যেকোনো বড় সাইজের ফাইল শেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়।
পরে ফোর–জিকে আরও দ্রুত করার জন্য এলটিই প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয় এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মুঠোফোন যন্ত্রে মুঠোফোন ব্রডব্যান্ড, মুঠোফোন আলট্রা ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট সেবা অন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জুনে মুঠোফোনে ফোর–জি (এলটিই) সেবা শুরু হয়। ফাইভ–জি প্রযুক্তিতে অনেকগুলো ডিভাইসকে একত্রে কানেক্ট (ইন্টারনেট অফ থিংস এর মতো) করে রাখার জন্য বিশেষ প্রযুক্তিসহ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে বেশি ব্যান্ডউইথ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা রাখে। আর মূলত এ বিষয়ের ওপর লক্ষ্য করেই ফাইভ-জি প্রযুক্তির যাত্রা শুরু।
🌴 ফোর-জির চেয়ে ফাইভ–জি নেটওয়ার্কে ১০ গুণ বেশি দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার এমবিপিএস গতিতে ডাউনলোড করা যাবে। গবেষকরা বলেছেন ৫জি নেটওয়ার্ক এর স্পিড হবে ১০ জিবিপিএস বা সেকেন্ডে ১০ গিগাবিট পর্যন্ত। যদিও ফাইভ-জি এর নেটওয়ার্ক ডিজাইনে এর পিক স্পিড ধরা হয়েছে ২০ গিগাবিট।
কিন্তু বাস্তবিক পরীক্ষাগুলোতে অবশ্য এত স্পিড পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন মোবাইল ডিভাইসে পরীক্ষাতে ১ থেকে ১.৫ গিগাবিট পর্যন্ত স্পিড পাওয়া গেছে। কিন্তু তার পরেও এটা বর্তমানের ৪জি এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন। ফাইভ’জি এর গড় গতি হতে পারে ১০০ Mbps এর চেয়ে বেশি।
সহজভাবে বললে, ৫ জি নেটওয়ার্কে আপনি ২ ঘণ্টার একটি ভিডিও ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ডাউনলোড করতে পারবেন। যেখানে ৪জি তে এই একই ভিডিও ডাউনলোড করতে ৭ মিনিটের মত সময় লাগে।
থ্রি–জি বা ফোর–জির মতো ফাইভ–জি প্রযুক্তি শুধু মুঠোফোন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয় বরং ওয়াই–ফাই এর মতো যেকোনো ডিভাইসেও থাকতে পারবে, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সবাইকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হবে এবং মেশিন, অবজেক্ট ও ডিভাইসগুলোকে একই সূত্রে গাঁথবে। এমনকি পারসোনাল কম্পিউটারেও একটি চিপ লাগানো যাবে। ফলে তথ্য আদান-প্রদান, ভিডিও কল, কল কনফারেন্স এবং ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, হাই রেজল্যুশন ভিডিও দেখা, চালকবিহীন গাড়ি, প্লেন চালানোর ট্রেনিং থেকে শুরু করে নানা গবেষণা কর্ম, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধারকাজে ড্রোন ব্যবহার করা সম্ভব হবে। গুগল ম্যাপ ব্যবহারেও অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। লোকেশন ট্র্যাকিং করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে না, মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ফলাফল দেবে। এমনকি উচ্চ ক্ষমতার এই মুঠোফোন ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোবট, সেন্সর বা অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্যেও ব্যবহৃত হবে। এর প্রভাব দেখা যাবে সব ক্ষেত্রে—আমাদের জীবনে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি খেলাধুলায়ও। ফাইভ–জি সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সব কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে, ফলে কাস্টমার সার্ভিস হয়ে উঠবে আরও সন্তোষজনক। এককথায় বলা যায়, গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দেবে।
ফাইভ–জি হাই ব্যান্ডউইথ হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি শুধু মুঠোফোন ইন্টারনেট নয়, বরং হোম ইন্টারনেটেও নিজের জায়গা দখল করে নেবে। গ্রামীণ, পাহাড়ি ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় এখনো উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছেনি কারণ, ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো লোকসানের আশঙ্কায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্রডব্যান্ড কেব্ল বা ফাইবার অপটিক কেব্ল স্থাপন করেনি সেখানে। ফাইভ–জি প্রযুক্তি চলে আসার পর ওই সব এলাকার লোকেরাও গিগাবাইট/সেকেন্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুবিধা পাবে এবং ইন্টারনেট অপারেটরদেরও আর মাটির নিচ দিয়ে কিংবা ওপর দিয়ে কেবল টানানোর প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে থাকবে মাত্র ১ মিলি সেকেন্ডের ল্যাটেন্সি এবং এটি ৯০ শতাংশ কম এনার্জি ব্যয় করে কাজ করবে। ডেটা ট্রান্সমিশনে সাধারণত ৩ দশমিক ৫ থেকে ২৬ গিগাহার্টজের মতো উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের অনেক ক্ষমতা থাকে। কিন্তু স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে তাদের আওতা কম থাকে, ফলে সামনে কোনো বাধা পেয়ে আটকে যায়।
ফাইভ–জির প্রযুক্তিতে এ সমস্যা একেবারেই থাকবে না। কারণ, এটি এমন একটি নতুন রেডিও প্রযুক্তি, যা রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার আরও বেশি নিশ্চিত করবে এবং একই সময় একই স্থানে বেশি মুঠোফোন ইন্টারনেটের সুবিধা নিতে পারবে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে, অনলাইন এডুকেশনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব নিয়ে আসবে। স্বাস্থ্য খাতেও ব্যাপক রদবদল ঘটাবে। মেডিকেল ডিভাইসের সঙ্গে ফাইভ–জি সিম ব্যবহার করে ডাক্তার দূরের কোনো রোগীকে শহরে বসেই জরুরি চিকিৎসা দিতে পারবেন। এমনকি রোবোটিক সিস্টেমের সাহায্যে রিমোট সার্জারি করতে পারবেন।
বডি ফিটনেস ডিভাইস নিজের শরীরের সঙ্গে ব্যবহার করে বডি থেকে সিগন্যাল পাঠাতে মিলি সেকেন্ড সময় লাগবে। গাড়ির লোকেশন, স্পিড, ডেস্টিনেশনসহ ট্রাফিকের সব ইনফরমেশন হাতের মুঠোয় চলে আসবে ফলে ড্রাইভিং, গাড়ি দুর্ঘটনা কমাতে সহায়ক হবে। গেমিং এক্সপেরিয়েন্সকে আরও সুখময় করে তুলবে। বিশেষ করে, অনলাইন গেমগুলোকে সবার কাছে অবাধ করে তুলবে ফলে মুঠোফোন গেমিং ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর বিস্তার ঘটবে।